নির্বাচন সংস্কারে আলোচনায় ৭ প্রস্তাব
- আপডেট সময় ১২:৩৮:১০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪
- / ১৩ বার পড়া হয়েছে
ডেস্ক নিউজ :
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত কমিশন বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করছে। বৈঠকে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, ‘না’ ভোটের বিধান পুনরায় চালু করা, নারী আসনে সরাসরি ভোট, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা, দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনা এবং নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদেরকে রিটার্নিং কর্মকর্তা করার প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে প্রায় সবাই একমত হয়েছেন। এ ছাড়া আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলও বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে। ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন এই কমিশন এসব প্রস্তাব সংগ্রহ শেষে পর্যালোচনা করে নির্বাচন সংস্কার বিষয়ে তাদের সুপারিশমালা অন্তর্বর্তী সরকারকে দিবেন।
১৯৯৬ সালে নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্বে থাকা সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা ১১ই নভেম্বর ইসি সংস্কার কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সেখানে তিনি বলেন, তৃণমূলের মতের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই জরুরি। সংস্কারের চেয়ে আইনের প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ বলেও জানান তিনি।
১৬ই নভেম্বর নির্বাচন কমিশন বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে সংস্কার কমিশন। সেখানে কমিশনে সাবেক আমলাদের আধিক্য না রাখা, নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, সংসদের আসনসংখ্যা বাড়ানো, ইসি’র নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করা, ‘না’ ভোটের বিধান আবার চালু করা, স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ভোটারের সমর্থনযুক্ত সইয়ের বিধান বাদ দেয়া, জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংজ্ঞায় ‘নির্বাচন’-এর সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত ও সুস্পষ্ট করা, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাদ দেয়া, নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনী অপরাধে সরকারি কর্মকর্তাদের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা দেয়া, হলফনামার তথ্য ও নির্বাচনী ব্যয় পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা, পোস্টাল ব্যালটে ভোটের ব্যবস্থা আরও বিস্তৃত ও সহজ করা, সরকারের মেয়াদ ৫ বছরের পরিবর্তে ৪ বছর করাসহ নানা প্রস্তাব উঠে আসে। এ ছাড়া আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষেও বিভিন্ন মত আসে।
২০শে নভেম্বর সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতির বদলে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনের পক্ষে মত দেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) আবদুর রউফ। এ ছাড়া পুলিশ ও প্রশাসনের বদলে সাধারণ মানুষের মাধ্যমে ভোট পরিচালনা করারও প্রস্তাব দেন তিনি। এদিন নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তারাও বৈঠক করেন কমিশনের সঙ্গে। সেখানে তারা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করার বিধান চেয়েছে। এ ছাড়া ভোটের সময় করা অপকর্মের জন্য সংশ্লিষ্টদের ভোটের পরও যেন আইনের আওতায় আনা যায়, সেই ক্ষমতাও দেয়ার সুপারিশ করেছেন তারা।
২১শে নভেম্বর সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, অনাবাসী প্রতিনিধিত্ব না করতে দেয়া, নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করতে রাষ্ট্রীয় খরচে নির্বাচনী প্রচারের ব্যবস্থা করা, গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনে না হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা, এনআইডি কার্ডকে ভোটার কার্ড হিসেবে ব্যবহার করা, তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহাল করা, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করেন।
২৩শে নভেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে ইলেকট্রিক মিডিয়ার সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা সংসদের আগে স্থানীয় নির্বাচনের প্রস্তাব করেন। এ ছাড়া প্রার্থীদের হলফনামা যাচাই, অনলাইন ভোট পদ্ধতি ও ‘না’ ভোট ফিরিয়ে আনা, রাষ্ট্রপতি পদে পরোক্ষ নয়, প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচন করার প্রস্তাব করেন। এদিন নারী নেত্রীদের সঙ্গেও বৈঠক করেন সংস্কার কমিশন। সেখানে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের নামে কোটা নয়, সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকারের নারী প্রতিনিধিত্ব চান নারী নেত্রীরা। এ ছাড়া সংসদের নারী আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ১৫০ করা, ইসি ও ইসি কর্মকর্তাদের এক-তৃতীয়াংশ নারী হওয়া, দলীয় কার্যক্রমে নারী ৩৩ শতাংশ নিশ্চিত করা, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।
২৪শে নভেম্বর নাগরিক সমাজ ও শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করে ইসি সংস্কার কমিশন। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী বিশেষ করে আর্থিক স্বাধীনতা দেয়া, ‘না’ ভোটের বিধান চালু করা, রাষ্ট্রপতির পদকে শক্তিশালী করা, মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করা, আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন, সব অংশীজনের সক্রিয় সংশ্লিষ্টতা থাকা, নির্বাচনে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, শপথ ভঙ্গের কারণে আগের কমিশনকে শাস্তির আওতায় আনার মতো প্রস্তাব এসেছে।
২৬শে নভেম্বর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। সেখানেও সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কাঠামো, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা, প্রবাসীদের ভোটাধিকার, আওয়ামী লীগকে ভোট করতে না দেয়া, পরিবারতন্ত্রের বাইরে গিয়ে দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিতকরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তাব তুলে ধরেন শিক্ষার্থীরা।
গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, দলিত ও প্রতিবন্ধীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে কমিশন। সেখানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না থাকা, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের জন্য সংসদে আসন বরাদ্দ রাখা, অভিযোগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত করে প্রার্থিতা বাতিল করার বিধান রাখা, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আদিবাসী প্রতিনিধি রাখাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব দেন তারা।
এদিকে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে। দলগুলোর দেয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে-নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, পরপর দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন না হওয়ার বিধান করা, সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা, নির্ভুল ও হালনাগাদ ভোটার তালিকা তৈরি করা, জাতীয় সংসদে অধিকতর দল ও মতের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি চালু করা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন ও দলীয় প্রতীক ব্যবহারের পদ্ধতি বাতিল করা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অধিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তি তার চাকরি বা পদ থেকে অব্যাহতি বা দায়িত্বমুক্ত হওয়ার পর ৫ বছর অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ না রাখা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইন বাতিল করা, রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা বা জনবলকে প্রাধান্য দেয়া, নির্বাচনী দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে তদন্তসাপেক্ষে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে ন্যস্ত করা, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা, নির্বাচিত সব জনপ্রতিনিধিকে প্রতি অর্থবছরে তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাবসহ সম্পদ বিবরণী তথা আয়কর রিটার্ন (আয়কর অফিসের রসিদসহ) এর কপি নির্বাচন কমিশনে দাখিল করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে মনোনয়নের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট আসনের ভোটারদের মধ্য থেকে ওই দলের নেতাকর্মীদের ভোটের মাধ্যমে প্রার্থী মনোনীত করার ব্যবস্থা করা, নির্বাচন কমিশনের সদস্য সংখ্যা বাড়ানো, বর্তমান বিধান বাতিল করে রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মতামতের ভিত্তিতে সার্চ কমিটি গঠনে আইন প্রণয়ন, সার্চ কমিটি কমিশনের সদস্য সংখ্যার দ্বিগুণ নাম চূড়ান্ত করে গণমাধ্যমে প্রচার ও গণশুনানির মাধ্যমে নাম চূড়ান্ত করা, সংরক্ষিত নারী আসন বাতিল করে সরাসরি নির্বাচন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রদান ও প্রার্থী হওয়ার বিধান যুক্ত করা, ৫০ শতাংশের নিচে ভোট পড়লে আবার নির্বাচন দেয়া, সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি ও প্লট প্রাপ্তির সুবিধা বাতিল করা, নির্বাচনে প্রার্থী কর্তৃক পোস্টার-ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড দিয়ে প্রচার নিষিদ্ধ করে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে কমন পোস্টার, মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছে।
সংলাপে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রস্তাব আসা বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, না ভোটের বিধান পুনরায় চালু করা, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা, দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার বিধান চালু করা, সংরক্ষিত নারী আসন বাতিল করে সরাসরি নির্বাচন দেয়ার মতো প্রস্তাবগুলো সবচেয়ে বেশি এসেছে। ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারী আসনে নির্বাচনের প্রস্তাব এসেছে। এতে ১০০ আসনে নারীরা সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেবেন। ফলে সংসদে ৪০০ আসন করতে হবে। লটারির মাধ্যমে প্রথমবার ১০০ আসনে, পরের বার অন্য ১০০ আসনে এভাবে চারবারে চারশ’ আসনে নারীরা সরাসরি অংশগ্রহণ করবে। আর অন্য আসনগুলো নারী ও পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।
সূত্র : মানবজমিন