কক্সবাজার ০৮:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সাক্ষাতকার : বদিউল আলম মজুমদার

সাক্ষাৎকার : প্রথম অগ্রাধিকার হবে ইসি গঠন আইনের সংশোধন-বদিউল আলম মজুমদার

নিজস্ব সংবাদদাতা :
  • আপডেট সময় ১২:২৮:৫৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ১৯ বার পড়া হয়েছে

ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘মাদার অফ অল ইভিলস’। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সকল অনিষ্টের গোড়ায় ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। প্রশ্ন হলো- এই সংকটের কি ইতি নেই? বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে ডজনখানেক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে তিন থেকে চারটি নির্বাচন ছিল বিতর্কমুক্ত, অংশগ্রহণমূলক। এর সবগুলোই হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। যে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়ে মাঠ তাতিয়েছে,  আন্দোলন করেছে তারাই এই ব্যবস্থা বাতিল করেছে। বিচারপতি খায়রুল হক জালিয়াতির রায় দিয়ে বিতর্ক আরও পোক্ত করেছেন। ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ ভোটারবিহীন নির্বাচনে সরকার চলেছে। এক অস্বাভাবিক কায়দায় ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিয়েছে ৫ই আগস্ট। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ৬টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সংস্কারে কমিশন করে দিয়েছেন। এরমধ্যে অন্যতম নির্বাচন কমিশন সংস্কার। মানবজমিন মুখোমুখি হয়েছে এই কমিশনের প্রধান সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার-এর। সাক্ষাৎকারে কমিশনের অগ্রাধিকার, সংকটের নেপথ্যে কী ছিল আর তা থেকে উত্তরণে কী ধরনের সুপারিশ থাকবে তা তুলে ধরেছেন। বিস্তারিত পাঠকের জন্য-  

প্রশ্ন: নির্বাচন কমিশন সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান হিসেবে আপনার নাম ঘোষণায় প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও সম্মানিত বোধ করেছি। প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় আমিসহ পাঁচজনের নাম সংস্কারে গঠিত কমিশনগুলোর প্রধান হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এটা শুধু সম্মানের নয়, বহুদিন ধরে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার কণ্ঠ ছিলাম। আমি ছাড়াও আমাদের অনেক সহযোগী, স্বেচ্ছাব্রতীরাও এ কাজের সহযোদ্ধা ছিলেন। তাদের সকলের কাজেরই এটা স্বীকৃতি। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গণতন্ত্রকে কার্যকর করার এটা একটি বড় সুযোগ। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে যে ধরনের রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার কারণে, একতরফা নির্বাচন হওয়ার ফলে। আমরা যদি একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করতে পারি তাহলে যে ধরনের মর্মান্তিকতা ঘটেছে, ব্যাপক জনবিস্ফোরণ ঘটেছে, হাজারও মানুষের প্রাণহানি, হতাহতের ঘটনা, এতো মানুষের আত্মত্যাগে যে সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে এটার প্রথম পদক্ষেপ হবে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন। এটা বিরাট সুযোগ এবং একইসঙ্গে গুরুদায়িত্ব।

প্রশ্ন: টেবিলের ওপাশ আর এপাশ। দীর্ঘদিন আপনি ছিলেন বিরোধী আসনে এবার আপনিও চালক। জনগণ অপেক্ষায় আপনার কী ধরনের সংস্কার পদক্ষেপ নেবেন তা দেখার? 
আমি এবং আমার একদল সহকর্মী আশাবাদী এই যে, আকাশচুম্বী সুযোগ আমরা পেয়েছি তা যেন কাজে লাগাতে পারি। আমরা যেন একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম করতে পারি। আমরা কিছু আইন-কানুন, বিধি-বিধান এবং প্রক্রিয়া অবলম্বনে সেই পথটা সুগম করতে পারি।

প্রশ্ন: নির্বাচনী ব্যবস্থায় কী ধরনের সংস্কার আপনারা আনতে চান? 
সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে আমাদের অনেকগুলো বাধা। বড় বাধা হচ্ছে- নির্বাচনে যারা অংশীজন তারা সঠিক ভূমিকা পালন করে না। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা বলা হয়েছে এবং তাদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করা হয়েছে যেন তাদেরকে পদচ্যুতি না করতে পারে। নির্বাচন কমিশন নিয়ে অনেক বিতর্ক, অনেক অভিযোগ। তারা সবচেয়ে বড় অংশীজন হয়েও সঠিক দায়িত্ব পালন করছে না। তারপর সরকারের অঙ্গ হিসেবে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। এরপরই আসে রাজনৈতিক দলের কথা। তারা যদি সঠিকভাবে সহযোগিতা করে, ছলেবলে কৌশলে নির্বাচনী বৈতরণী পার না হতে চায় এবং গণমাধ্যম যদি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে, সত্য তুলে ধরে, নাগরিক সমাজও নজরদারির যে ভূমিকা পালন করা দরকার তা গুরুত্ব দিয়ে পালন করে তাহলে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। এই সকল অংশীজনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন কমিশন। দুঃখজনক হলেও সত্য বিগত তিনটি নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়েই ব্যাপক বিতর্ক ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে। ২০২২ সালে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে একটি আইন প্রণয়ন হয়েছে যা অগ্রহণযোগ্য। এই আইনের ফলেই সরকারের যারা অনুগত, খয়ের খাঁ তারা কমিশনে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। এই আইনের মধ্যেই একটি বিধান আছে সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের। কিন্তু বর্তমান বিধানের আওতায় কয়েকটি সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা এই অনুসন্ধান কমিটির সদস্য হন। এসব ব্যক্তির নিয়োগই দেয়া হয় তারা যেন সরকারের প্রতি অনুগত থাকে। এই বিধানে আছে অন্তত দু’জন ব্যক্তিকে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগ দেয়া। আর সরকারের পক্ষ থেকে তাদের অনুগতদেরই নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। তারা যাকে চায় তাকেই নিয়োগ দিতে পারে এই সার্চ কমিটিতে। গত তিনটি কমিশন এভাবেই গঠিত হয়েছে। এটা হয়ে থাকে কখনও প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কখনও আইনের মাধ্যমে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা তো আর আম গাছ থেকে জাম পাবো না। আবারও যদি পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশন হয়, মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন হয়, অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিশন গঠিত হয় তাহলে তো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন পাবো না।

প্রশ্ন: কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় সংস্কার আনা আপনাদের প্রায়োরিটির মধ্যে আছে? 
তাদেরই দায় সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। কাজেই প্রথম কাজ হবে নির্বাচন কমিশন গঠনের আইনি কাঠামোতে সংস্কার নিয়ে আসা। আমরা আইনটি সংস্কার করবো যাতে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠন করা যায়। কমিশন যেন কোনো দলের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে গঠিত না হয়। প্রাথমিক চিন্তায় আছে, প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধি, প্রধান বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি, তৃতীয় প্রধান দলের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি, গণমাধ্যমের একজন প্রতিনিধি থাকবে সার্চ কমিটিতে যাতে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায়। অনুসন্ধান কমিটি যেন সকলের মতের ভিত্তিতে এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হয় তা আমাদের সংস্কারে অগ্রাধিকার পাবে। সার্চ কমিটি যাদের নাম প্রাথমিক বিবেচনায় নেবে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা এবং তাদের নিয়ে গণশুনানির আয়োজন করা। এতে যারা পরিচ্ছন্ন নয়, তারা এ প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকবে। এর মাধ্যমে যোগ্যদের নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনার দ্বার উন্মেচিত হবে।

প্রশ্ন: নির্বাচন কমিশন সচিব সরকারের নিয়োগকৃত থাকে বলে একটি টানাপড়েন রয়েই যায়? তার সুরাহা কীভাবে হবে? 
২০০৭ সালে হুদা কমিশন গঠনের আগে এবং পরেও নির্বাচন কমিশনে কিছু কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কথা হচ্ছে- এরাই নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তাদের মধ্য থেকে যদি সচিব নিয়োগ দেয়া হয়, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল থেকে যদি সচিব নিয়োগ দেয়া হয় তাহলে এ সমস্যা দূরীভূত হবে। সচিব পদমর্যদার বা উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিরা যদি সরকারের পছন্দের লোক না হয় তাহলে নির্বাচনকালীন সংকটের নিরসন হবে। আগামী নির্বাচন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হবে তাই এ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না বলেই মনে করি। আমি নিশ্চিত করেই বলতে চাই, আগামী নির্বাচন প্রভাবিত করবে সে রকম অপচেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার করবে না। আগামী নির্বাচন যদি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হয় তাহলে পরবর্তী সরকার যারা গঠন করবে তখন নিয়োগকৃত সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সচিব নেয়া সম্ভব হবে বলে মনে করি।

প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকার বলে আপনি আশাবাদী কিন্তু এ সরকার তো সবসময় থাকবে না? 
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি আমাদের এ যাবৎকালে ১২টির মতো নির্বাচন হয়েছে। চারটি নির্বাচন হয়েছে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এরমধ্যে তিনটি নির্বাচন সকলের কাছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এই নির্বাচনগুলোতে পূর্ববর্তী সরকার জনগণের ভোটের মাধ্যমে বিদায় হয়েছে। রাজনৈতিক ঐকমত্য বা পলিটিক্যাল সেটেলমেন্টের ভিত্তিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল বিএনপি প্রথমদিকে এটি না মানলেও পরে তারা সংবিধানে এটি অন্তর্ভুক্ত করে পদত্যাগ করে।  ২০১১ সালে একতরফা এবং বিতর্কিতভাবে আদালতের নির্দেশ লঙ্ঘন করে সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে এবং যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার থাকা দরকার তা তত্ত্বাবধায়ক বা অন্য যে কোনো নামেই হোক।

প্রশ্ন: আপনাদের সংস্কার প্রস্তাবনায় জাতীয় নির্বাচনগুলো নিরপেক্ষ বডি দিয়ে করার সুপারিশ থাকবে কিনা? 
আমরা হয়তো সুপারিশ করতে পারবো। এটা কার্যকর করার জন্য আমাদের সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তবে আশার কথা আমাদের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের জন্য একটি রিট দায়ের করা হয়েছে। আমিসহ চারজন এই রিট করেছি শুধু এটি নয়, ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে খায়রুল হকের যে রায় তা রিভিউয়ের জন্যও আমরা আবেদন করেছি। রায়গুলো আমাদের পক্ষে এলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবার ফিরে আসবে। আমাদের সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারে যে ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার তারা তা করবে।

প্রশ্ন: প্রেক্ষাপট বদলেছে, আদালতেও ভিন্ন পরিস্থিতি। এ অবস্থায় রিটে রায় পাবেন বলে আশাবাদী? 
আমরা অত্যন্ত আশাবাদী। আমাদের অকাট্য যুক্তি আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে সংবিধান লঙ্ঘন করে অযৌক্তিকভাবে। এ নিয়ে ভয়ানক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে রায় বাতিল করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছিল একটি রাজনৈতিক বিষয়। রাজনীতিকরা পলিটিক্যাল সেটেলমেন্টের অংশ হিসেবে এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন। রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ করা সমীচীন নয়। একেবারেই অগ্রহণযোগ্য যুক্তিতে তারা রায়টি বাতিল করেছেন যা ছিল ভুল। সংবিধানে কতগুলো বিষয় অলঙ্ঘনীয়। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এমন মৌলিক বিষয়গুলো সংশোধন কালেও বাতিল করা যাবে না। যারা রায় বাতিল করেছেন তাদের যুক্তি ছিল তিনমাসের অনির্বাচিত সরকার সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অথচ এর বিপরীতে এটি না থাকলেও আমাদের গণতন্ত্রে পাতানো নির্বাচনের খেলা চলে আসছে। খায়রুল হক তড়িঘড়ি করে অবসরে যাওয়ার আগে এই রায় দিয়েছিলেন যা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর দু’টি বেঞ্চেই এই রায়টি ছিল বিভক্ত। অ্যমিকাস কিউরিদের আটজনের মধ্যে সাতজনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার রেখেই রায় দেয়ার কথা বলেছিলেন। এমনকি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাও তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে ছিলেন। যদিও আপিল বিভাগের মেজরিটির রায়ে এটি চূড়ান্ত হয়। খায়রুল হক ১০ই মে ২০১১ তারিখে সংক্ষিপ্ত আদেশে বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ভবিষ্যতের জন্য অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলো। রাষ্ট্র এবং জনগণের নিরাপত্তা বিবেচনায় ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে পরবর্তী দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। সংসদ চাইলে বিচারপতিদের বাদ দেয়ার জন্য ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে সংশোধন আনতে পারে। লক্ষ্যণীয় তিনি এটাকে সংশোধনের কথা বলেছেন এবং দুইবারের পর তা বাতিলের কথা বলেছেন। কিন্তু আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এই রায় নিয়ে বলেছেন, আমি তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করিনি, আদালত বাতিল করেছে। তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর, সত্যের অপলাপ। খায়রুল হকের রায়ও ছিল স্বার্থ প্রণোদিত। রায়ে উল্লিখিত দুইটি নির্বাচন যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতো তাহলে খায়রুল হক হতেন প্রধান উপদেষ্টা। তিন- চার লাইনের দেয়া শর্ট অর্ডার। শর্ট অর্ডারই চূড়ান্ত রায়। এটাই মূল সিদ্ধান্ত। আর বিস্তারিত রায় দেন ষোল মাস পরে। পরবর্তীতে বিস্তারিত রায়ে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বলেছেন তিনি তাই লিখে দিয়েছেন। এরমধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় খায়রুল হকের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকেই তিনি ফলো করেছেন আর এটা করতে গিয়ে তিনি আদালতের সঙ্গে জালিয়াতি করেছেন।  তিনি পুনরায় শুনানি না করে, সকলের মত না নিয়ে রায় পাল্টে দিয়েছিলেন। খায়রুল হক নির্বাচনী ব্যবস্থার কবর দিয়েছিলেন। এর ফলেই ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালে পরপর তিনবার জালিয়াতির আর একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার থাকলে ভোটারবিহীন জালিয়াতির নির্বাচন করা সম্ভব হতো না। পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের উদ্দ্যেশ্যই ছিল ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা।

প্রশ্ন: সুজনের দেয়া সংস্কার প্রস্তাবের একটি হচ্ছে, কমিশন গঠনে রাজনৈতিক ভারসাম্য নিশ্চিত করা। 
কমিশন গঠন অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমেই হবে। অনুসন্ধান কমিটি এমনভাবে গঠিত হবে তা যেন সরকারের অনুগত না হয়। সরকার যাকে চাইবে তাকে যেন নিয়োগ না দেয়া হয়। পাতানো নির্বাচন কমিশন যাতে গঠিত না হয়। আগেই বলেছি, অনুসন্ধান কমিটিতে সরকার পক্ষের একজন, প্রধান বিরোধীদলের একজন, তৃতীয় প্রধান দলের একজন থাকবেন আর ইসি নিয়োগে তাদের একমত হতে হবে। এভাবেই আমরা রাজনৈতিক ভারসাম্য নিশ্চিতের কথা বলছি।

প্রশ্ন: সুষ্ঠুু নির্বাচন আয়োজনে প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তির সদ্বিচ্ছাও গুরুত্বপূর্ণ কিনা? নিকট অতীতে ভারতে দেখা গেছে টিএন সেশন কমিশন আলোচনায় এসেছে ব্যক্তির কারণে। 
ব্যক্তিও গুরুত্বপূর্ণ একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যদি সহযোগিতা না করে বিশেষ করে সরকারের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খবাহিনী যদি অসদাচরণ করে, পক্ষপাতদুষ্ট থাকে এবং গণমাধ্যম যদি একতরফা প্রচার-প্রচারণা চালায়, নাগরিক সমাজ যদি নজরদারির ভূমিকা পালন করতে না পারে- তাহলে মেরুদণ্ডসম্পন্ন নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। যে নির্বাচন আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক নয়, সেই নির্বাচন আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর জন্য সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তাদের কাজ হচ্ছে নির্বাচন করা। কিন্তু আমি বলবো, তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তারা পোস্ট অফিস নয়। তারা শপথ নিয়ে সংবিধান রক্ষার। অথচ তারা সংবিধানকে পদদলিত করেছে।

প্রশ্ন: আপনার একটি বক্তব্য আলোচনায়, আপনি বলেছেন- আওয়ামী লীগ অংশ না নিলে নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য হবে না। প্রশ্ন থাকে, তাহলে তা কি সকলের অংশগ্রহণমূলক হবে? 
নির্বাচন মানেই একটি প্রতিযোগিতা। বিকল্পের মধ্য থেকে বেছে নেয়া। নির্বাচনে বিকল্প থাকতে হবে। বিকল্প হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প। প্রশ্নটি ছিল হাইপোথ্যাটিক্যাল। উত্তরটি খণ্ডিতভাবে প্রচারিত হয়েছে। বক্তব্যটি ছিল, আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। এই নির্বাচনে অন্তর্বর্তী সরকার কাউকেই বাধা দেবে না। বর্তমানে আওয়ামী লীগের অনেকেই পলাতক, অনেকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে। তারা যদি সংগঠিত হতে না পারে এবং নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে তাহলে নির্বাচন তো আটকে রাখা যাবে না। আমি আশা করি সবার অংশগ্রহণে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।

প্রশ্ন: তিন মাসের মধ্যে কি আপনার প্রস্তাবনা দেয়া সম্ভব হবে?
সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সব সংস্কার হবে না। সবগুলো দিক হয়তো আমরা গভীরভাবে পর্যালোচনা করার সময়ও পাবো না। তবুও আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করবো যেন এই তিন মাসের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য সুপারিশমালা পেশ করতে পারি।

সূত্র : মানবজমিন

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

সাক্ষাতকার : বদিউল আলম মজুমদার

সাক্ষাৎকার : প্রথম অগ্রাধিকার হবে ইসি গঠন আইনের সংশোধন-বদিউল আলম মজুমদার

আপডেট সময় ১২:২৮:৫৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘মাদার অফ অল ইভিলস’। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সকল অনিষ্টের গোড়ায় ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। প্রশ্ন হলো- এই সংকটের কি ইতি নেই? বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে ডজনখানেক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে তিন থেকে চারটি নির্বাচন ছিল বিতর্কমুক্ত, অংশগ্রহণমূলক। এর সবগুলোই হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। যে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়ে মাঠ তাতিয়েছে,  আন্দোলন করেছে তারাই এই ব্যবস্থা বাতিল করেছে। বিচারপতি খায়রুল হক জালিয়াতির রায় দিয়ে বিতর্ক আরও পোক্ত করেছেন। ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ ভোটারবিহীন নির্বাচনে সরকার চলেছে। এক অস্বাভাবিক কায়দায় ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিয়েছে ৫ই আগস্ট। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ৬টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সংস্কারে কমিশন করে দিয়েছেন। এরমধ্যে অন্যতম নির্বাচন কমিশন সংস্কার। মানবজমিন মুখোমুখি হয়েছে এই কমিশনের প্রধান সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার-এর। সাক্ষাৎকারে কমিশনের অগ্রাধিকার, সংকটের নেপথ্যে কী ছিল আর তা থেকে উত্তরণে কী ধরনের সুপারিশ থাকবে তা তুলে ধরেছেন। বিস্তারিত পাঠকের জন্য-  

প্রশ্ন: নির্বাচন কমিশন সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান হিসেবে আপনার নাম ঘোষণায় প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও সম্মানিত বোধ করেছি। প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় আমিসহ পাঁচজনের নাম সংস্কারে গঠিত কমিশনগুলোর প্রধান হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এটা শুধু সম্মানের নয়, বহুদিন ধরে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার কণ্ঠ ছিলাম। আমি ছাড়াও আমাদের অনেক সহযোগী, স্বেচ্ছাব্রতীরাও এ কাজের সহযোদ্ধা ছিলেন। তাদের সকলের কাজেরই এটা স্বীকৃতি। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গণতন্ত্রকে কার্যকর করার এটা একটি বড় সুযোগ। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে যে ধরনের রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার কারণে, একতরফা নির্বাচন হওয়ার ফলে। আমরা যদি একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করতে পারি তাহলে যে ধরনের মর্মান্তিকতা ঘটেছে, ব্যাপক জনবিস্ফোরণ ঘটেছে, হাজারও মানুষের প্রাণহানি, হতাহতের ঘটনা, এতো মানুষের আত্মত্যাগে যে সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে এটার প্রথম পদক্ষেপ হবে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন। এটা বিরাট সুযোগ এবং একইসঙ্গে গুরুদায়িত্ব।

প্রশ্ন: টেবিলের ওপাশ আর এপাশ। দীর্ঘদিন আপনি ছিলেন বিরোধী আসনে এবার আপনিও চালক। জনগণ অপেক্ষায় আপনার কী ধরনের সংস্কার পদক্ষেপ নেবেন তা দেখার? 
আমি এবং আমার একদল সহকর্মী আশাবাদী এই যে, আকাশচুম্বী সুযোগ আমরা পেয়েছি তা যেন কাজে লাগাতে পারি। আমরা যেন একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম করতে পারি। আমরা কিছু আইন-কানুন, বিধি-বিধান এবং প্রক্রিয়া অবলম্বনে সেই পথটা সুগম করতে পারি।

প্রশ্ন: নির্বাচনী ব্যবস্থায় কী ধরনের সংস্কার আপনারা আনতে চান? 
সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে আমাদের অনেকগুলো বাধা। বড় বাধা হচ্ছে- নির্বাচনে যারা অংশীজন তারা সঠিক ভূমিকা পালন করে না। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা বলা হয়েছে এবং তাদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করা হয়েছে যেন তাদেরকে পদচ্যুতি না করতে পারে। নির্বাচন কমিশন নিয়ে অনেক বিতর্ক, অনেক অভিযোগ। তারা সবচেয়ে বড় অংশীজন হয়েও সঠিক দায়িত্ব পালন করছে না। তারপর সরকারের অঙ্গ হিসেবে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। এরপরই আসে রাজনৈতিক দলের কথা। তারা যদি সঠিকভাবে সহযোগিতা করে, ছলেবলে কৌশলে নির্বাচনী বৈতরণী পার না হতে চায় এবং গণমাধ্যম যদি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে, সত্য তুলে ধরে, নাগরিক সমাজও নজরদারির যে ভূমিকা পালন করা দরকার তা গুরুত্ব দিয়ে পালন করে তাহলে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। এই সকল অংশীজনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন কমিশন। দুঃখজনক হলেও সত্য বিগত তিনটি নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়েই ব্যাপক বিতর্ক ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে। ২০২২ সালে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে একটি আইন প্রণয়ন হয়েছে যা অগ্রহণযোগ্য। এই আইনের ফলেই সরকারের যারা অনুগত, খয়ের খাঁ তারা কমিশনে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। এই আইনের মধ্যেই একটি বিধান আছে সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের। কিন্তু বর্তমান বিধানের আওতায় কয়েকটি সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা এই অনুসন্ধান কমিটির সদস্য হন। এসব ব্যক্তির নিয়োগই দেয়া হয় তারা যেন সরকারের প্রতি অনুগত থাকে। এই বিধানে আছে অন্তত দু’জন ব্যক্তিকে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগ দেয়া। আর সরকারের পক্ষ থেকে তাদের অনুগতদেরই নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। তারা যাকে চায় তাকেই নিয়োগ দিতে পারে এই সার্চ কমিটিতে। গত তিনটি কমিশন এভাবেই গঠিত হয়েছে। এটা হয়ে থাকে কখনও প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কখনও আইনের মাধ্যমে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা তো আর আম গাছ থেকে জাম পাবো না। আবারও যদি পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশন হয়, মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন হয়, অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিশন গঠিত হয় তাহলে তো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন পাবো না।

প্রশ্ন: কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় সংস্কার আনা আপনাদের প্রায়োরিটির মধ্যে আছে? 
তাদেরই দায় সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। কাজেই প্রথম কাজ হবে নির্বাচন কমিশন গঠনের আইনি কাঠামোতে সংস্কার নিয়ে আসা। আমরা আইনটি সংস্কার করবো যাতে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠন করা যায়। কমিশন যেন কোনো দলের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে গঠিত না হয়। প্রাথমিক চিন্তায় আছে, প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধি, প্রধান বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি, তৃতীয় প্রধান দলের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি, গণমাধ্যমের একজন প্রতিনিধি থাকবে সার্চ কমিটিতে যাতে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায়। অনুসন্ধান কমিটি যেন সকলের মতের ভিত্তিতে এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হয় তা আমাদের সংস্কারে অগ্রাধিকার পাবে। সার্চ কমিটি যাদের নাম প্রাথমিক বিবেচনায় নেবে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা এবং তাদের নিয়ে গণশুনানির আয়োজন করা। এতে যারা পরিচ্ছন্ন নয়, তারা এ প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকবে। এর মাধ্যমে যোগ্যদের নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনার দ্বার উন্মেচিত হবে।

প্রশ্ন: নির্বাচন কমিশন সচিব সরকারের নিয়োগকৃত থাকে বলে একটি টানাপড়েন রয়েই যায়? তার সুরাহা কীভাবে হবে? 
২০০৭ সালে হুদা কমিশন গঠনের আগে এবং পরেও নির্বাচন কমিশনে কিছু কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কথা হচ্ছে- এরাই নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তাদের মধ্য থেকে যদি সচিব নিয়োগ দেয়া হয়, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল থেকে যদি সচিব নিয়োগ দেয়া হয় তাহলে এ সমস্যা দূরীভূত হবে। সচিব পদমর্যদার বা উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিরা যদি সরকারের পছন্দের লোক না হয় তাহলে নির্বাচনকালীন সংকটের নিরসন হবে। আগামী নির্বাচন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হবে তাই এ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না বলেই মনে করি। আমি নিশ্চিত করেই বলতে চাই, আগামী নির্বাচন প্রভাবিত করবে সে রকম অপচেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার করবে না। আগামী নির্বাচন যদি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হয় তাহলে পরবর্তী সরকার যারা গঠন করবে তখন নিয়োগকৃত সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সচিব নেয়া সম্ভব হবে বলে মনে করি।

প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকার বলে আপনি আশাবাদী কিন্তু এ সরকার তো সবসময় থাকবে না? 
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি আমাদের এ যাবৎকালে ১২টির মতো নির্বাচন হয়েছে। চারটি নির্বাচন হয়েছে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এরমধ্যে তিনটি নির্বাচন সকলের কাছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এই নির্বাচনগুলোতে পূর্ববর্তী সরকার জনগণের ভোটের মাধ্যমে বিদায় হয়েছে। রাজনৈতিক ঐকমত্য বা পলিটিক্যাল সেটেলমেন্টের ভিত্তিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল বিএনপি প্রথমদিকে এটি না মানলেও পরে তারা সংবিধানে এটি অন্তর্ভুক্ত করে পদত্যাগ করে।  ২০১১ সালে একতরফা এবং বিতর্কিতভাবে আদালতের নির্দেশ লঙ্ঘন করে সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে এবং যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার থাকা দরকার তা তত্ত্বাবধায়ক বা অন্য যে কোনো নামেই হোক।

প্রশ্ন: আপনাদের সংস্কার প্রস্তাবনায় জাতীয় নির্বাচনগুলো নিরপেক্ষ বডি দিয়ে করার সুপারিশ থাকবে কিনা? 
আমরা হয়তো সুপারিশ করতে পারবো। এটা কার্যকর করার জন্য আমাদের সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তবে আশার কথা আমাদের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের জন্য একটি রিট দায়ের করা হয়েছে। আমিসহ চারজন এই রিট করেছি শুধু এটি নয়, ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে খায়রুল হকের যে রায় তা রিভিউয়ের জন্যও আমরা আবেদন করেছি। রায়গুলো আমাদের পক্ষে এলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবার ফিরে আসবে। আমাদের সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারে যে ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার তারা তা করবে।

প্রশ্ন: প্রেক্ষাপট বদলেছে, আদালতেও ভিন্ন পরিস্থিতি। এ অবস্থায় রিটে রায় পাবেন বলে আশাবাদী? 
আমরা অত্যন্ত আশাবাদী। আমাদের অকাট্য যুক্তি আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে সংবিধান লঙ্ঘন করে অযৌক্তিকভাবে। এ নিয়ে ভয়ানক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে রায় বাতিল করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছিল একটি রাজনৈতিক বিষয়। রাজনীতিকরা পলিটিক্যাল সেটেলমেন্টের অংশ হিসেবে এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন। রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ করা সমীচীন নয়। একেবারেই অগ্রহণযোগ্য যুক্তিতে তারা রায়টি বাতিল করেছেন যা ছিল ভুল। সংবিধানে কতগুলো বিষয় অলঙ্ঘনীয়। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এমন মৌলিক বিষয়গুলো সংশোধন কালেও বাতিল করা যাবে না। যারা রায় বাতিল করেছেন তাদের যুক্তি ছিল তিনমাসের অনির্বাচিত সরকার সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অথচ এর বিপরীতে এটি না থাকলেও আমাদের গণতন্ত্রে পাতানো নির্বাচনের খেলা চলে আসছে। খায়রুল হক তড়িঘড়ি করে অবসরে যাওয়ার আগে এই রায় দিয়েছিলেন যা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর দু’টি বেঞ্চেই এই রায়টি ছিল বিভক্ত। অ্যমিকাস কিউরিদের আটজনের মধ্যে সাতজনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার রেখেই রায় দেয়ার কথা বলেছিলেন। এমনকি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাও তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে ছিলেন। যদিও আপিল বিভাগের মেজরিটির রায়ে এটি চূড়ান্ত হয়। খায়রুল হক ১০ই মে ২০১১ তারিখে সংক্ষিপ্ত আদেশে বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ভবিষ্যতের জন্য অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলো। রাষ্ট্র এবং জনগণের নিরাপত্তা বিবেচনায় ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে পরবর্তী দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। সংসদ চাইলে বিচারপতিদের বাদ দেয়ার জন্য ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে সংশোধন আনতে পারে। লক্ষ্যণীয় তিনি এটাকে সংশোধনের কথা বলেছেন এবং দুইবারের পর তা বাতিলের কথা বলেছেন। কিন্তু আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এই রায় নিয়ে বলেছেন, আমি তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করিনি, আদালত বাতিল করেছে। তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর, সত্যের অপলাপ। খায়রুল হকের রায়ও ছিল স্বার্থ প্রণোদিত। রায়ে উল্লিখিত দুইটি নির্বাচন যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতো তাহলে খায়রুল হক হতেন প্রধান উপদেষ্টা। তিন- চার লাইনের দেয়া শর্ট অর্ডার। শর্ট অর্ডারই চূড়ান্ত রায়। এটাই মূল সিদ্ধান্ত। আর বিস্তারিত রায় দেন ষোল মাস পরে। পরবর্তীতে বিস্তারিত রায়ে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বলেছেন তিনি তাই লিখে দিয়েছেন। এরমধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় খায়রুল হকের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকেই তিনি ফলো করেছেন আর এটা করতে গিয়ে তিনি আদালতের সঙ্গে জালিয়াতি করেছেন।  তিনি পুনরায় শুনানি না করে, সকলের মত না নিয়ে রায় পাল্টে দিয়েছিলেন। খায়রুল হক নির্বাচনী ব্যবস্থার কবর দিয়েছিলেন। এর ফলেই ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালে পরপর তিনবার জালিয়াতির আর একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার থাকলে ভোটারবিহীন জালিয়াতির নির্বাচন করা সম্ভব হতো না। পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের উদ্দ্যেশ্যই ছিল ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা।

প্রশ্ন: সুজনের দেয়া সংস্কার প্রস্তাবের একটি হচ্ছে, কমিশন গঠনে রাজনৈতিক ভারসাম্য নিশ্চিত করা। 
কমিশন গঠন অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমেই হবে। অনুসন্ধান কমিটি এমনভাবে গঠিত হবে তা যেন সরকারের অনুগত না হয়। সরকার যাকে চাইবে তাকে যেন নিয়োগ না দেয়া হয়। পাতানো নির্বাচন কমিশন যাতে গঠিত না হয়। আগেই বলেছি, অনুসন্ধান কমিটিতে সরকার পক্ষের একজন, প্রধান বিরোধীদলের একজন, তৃতীয় প্রধান দলের একজন থাকবেন আর ইসি নিয়োগে তাদের একমত হতে হবে। এভাবেই আমরা রাজনৈতিক ভারসাম্য নিশ্চিতের কথা বলছি।

প্রশ্ন: সুষ্ঠুু নির্বাচন আয়োজনে প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তির সদ্বিচ্ছাও গুরুত্বপূর্ণ কিনা? নিকট অতীতে ভারতে দেখা গেছে টিএন সেশন কমিশন আলোচনায় এসেছে ব্যক্তির কারণে। 
ব্যক্তিও গুরুত্বপূর্ণ একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যদি সহযোগিতা না করে বিশেষ করে সরকারের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খবাহিনী যদি অসদাচরণ করে, পক্ষপাতদুষ্ট থাকে এবং গণমাধ্যম যদি একতরফা প্রচার-প্রচারণা চালায়, নাগরিক সমাজ যদি নজরদারির ভূমিকা পালন করতে না পারে- তাহলে মেরুদণ্ডসম্পন্ন নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। যে নির্বাচন আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক নয়, সেই নির্বাচন আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর জন্য সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তাদের কাজ হচ্ছে নির্বাচন করা। কিন্তু আমি বলবো, তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তারা পোস্ট অফিস নয়। তারা শপথ নিয়ে সংবিধান রক্ষার। অথচ তারা সংবিধানকে পদদলিত করেছে।

প্রশ্ন: আপনার একটি বক্তব্য আলোচনায়, আপনি বলেছেন- আওয়ামী লীগ অংশ না নিলে নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য হবে না। প্রশ্ন থাকে, তাহলে তা কি সকলের অংশগ্রহণমূলক হবে? 
নির্বাচন মানেই একটি প্রতিযোগিতা। বিকল্পের মধ্য থেকে বেছে নেয়া। নির্বাচনে বিকল্প থাকতে হবে। বিকল্প হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প। প্রশ্নটি ছিল হাইপোথ্যাটিক্যাল। উত্তরটি খণ্ডিতভাবে প্রচারিত হয়েছে। বক্তব্যটি ছিল, আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। এই নির্বাচনে অন্তর্বর্তী সরকার কাউকেই বাধা দেবে না। বর্তমানে আওয়ামী লীগের অনেকেই পলাতক, অনেকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে। তারা যদি সংগঠিত হতে না পারে এবং নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে তাহলে নির্বাচন তো আটকে রাখা যাবে না। আমি আশা করি সবার অংশগ্রহণে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।

প্রশ্ন: তিন মাসের মধ্যে কি আপনার প্রস্তাবনা দেয়া সম্ভব হবে?
সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সব সংস্কার হবে না। সবগুলো দিক হয়তো আমরা গভীরভাবে পর্যালোচনা করার সময়ও পাবো না। তবুও আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করবো যেন এই তিন মাসের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য সুপারিশমালা পেশ করতে পারি।

সূত্র : মানবজমিন