কক্সবাজার ১০:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইসরাইলের চূড়ান্ত যুদ্ধ ও বিলোপ শঙ্কা

নিজস্ব সংবাদদাতা :
  • আপডেট সময় ০১:২৬:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪
  • / ২৯ বার পড়া হয়েছে

মাসুম খলিলী      ১৫ অক্টোবর ২০২৪

ইসরাইল কি মধ্যপ্রাচ্যে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু করেছে? দেশটির শীর্ষ নেতাদের কথায় সেটিই মনে হওয়া স্বাভাবিক। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটিচ এক্স বার্তায় লিখেছেন, ‘আমি এমন একটি ইহুদি রাষ্ট্র চাই যাতে জর্দান, লেবানন এবং মিসর, সিরিয়া, ইরাক ও সৌদি আরবের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত থাকে। আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ রাবীদের মতে, জেরুজালেম থেকে দামেস্ক পর্যন্ত সমস্ত পথ আমাদের জন্য প্রসারিত হবে।’

অন্যদিকে নেতানিয়াহুর সর্বশেষ এক্স বার্তা হলো, ‘একটি দীর্ঘ যুদ্ধের অতল গহ্বরে পতিত হওয়ার আগে লেবাননকে বাঁচানোর একটি সুযোগ রয়েছে। সেটি না নিলে যা আমরা গাজায় ঘটতে দেখছি সেই ধ্বংস ও দুর্ভোগের দিকে লেবাননকে নিয়ে যাবে।’ নেতানিয়াহু চাইছেন, লেবাননের সরকার ও সেনাবাহিনী হিজবুল্লাহর বিপক্ষে গিয়ে ইসরাইলের কাছে আত্মসমর্পণ করুক। সেটি হলে বেজালেল স্মোটিচের চাওয়া অনুসারে লেবাননকে ইসরাইলের মানচিত্রভুক্ত করা সম্ভব হবে।

অন্যরা কী ভাবছেন
ইসরাইল যে তার মানচিত্র স¤প্রসারণের যুদ্ধ শুরু করেছে সেটি এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। ইরান অক্ষ ছাড়া ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আরব নেতারা খুব একটা কথা বলেন না। এরদোগান বলছেন; কিন্তু তিনি ঠিক কতটা বা কবে কী করবেন তা অনুমান করা মুশকিল। তবে তুরস্কের সামনে ব্যাপক ঝুঁকি রয়েছে। দেশটির শাসক জোটের অন্যতম নেতা বাসেলিও বলেছেন, ‘আজ, সমস্যাটি বৈরুতের নয়, আঙ্কারার। টার্গেট ইস্তাম্বুল, দামেস্ক ও বাগদাদ নয়। ইসরাইলের গোপন এজেন্ডায় রয়েছে তুরস্ক। ক্ষেপণাস্ত্র ও হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী টার্গেট আনাতোলিয়ান ভ‚গোল। আপনি যদি পুরনো রাজনৈতিক গতিশীলতা পরিবর্তন করেন তবে আপনি এই ভ‚গোলটি হারাবেন। এটাই আজকের বিপদ।’

বাসেলির বক্তব্য, ‘ইসরাইলকে থামাতে জরুরিভাবে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে।’ খুবই সত্য এবং তা এত গুরুত্বপূর্ণ যে, কেউ ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘আত্মরক্ষামূলক’ অবস্থানে থাকলে সে হেরে যাবে।

বস্তুত ৭ অক্টোবর হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক বছর পর মধ্যপ্রাচ্য আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে চলে এসেছে যে এই অঞ্চলে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ইসরাইল যে কোনো সময় ইরানে হামলা করবে বলে ঘোষণা করেছেন নেতানিয়াহু। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োব গ্যালান্ট বলেছেন, এই হামলা হবে সুনির্দিষ্ট বিপর্যয়কর ও ধ্বংসকরী। জবাবে ইরান ইসরাইলের ডেমোনা পরমাণু প্রকল্পের একটি নকশা প্রকাশ করে দুই মিনিটের এক ভিডিও প্রকাশ করেছে। তাতে তেহরান এই বার্তা দিয়েছে যে, ইরানে হামলা হলে তার প্রতিশোধ হবে ভয়ঙ্কর। ইরানের তেলক্ষেত্রে হামলা হলে ইসরাইলের তেলক্ষেত্র অবশিষ্ট থাকবে না।

ভয়ঙ্কর যুদ্ধ?
ইরান-ইসরাইলের এই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া যে কতটা ভয়ঙ্কর হবে তা অনুমান করে যুক্তরাষ্ট্র এটি ঠেকানোর জন্য কাজ শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। যদিও ইসরাইলকে নিবৃত্ত করার ক্ষমতা কতটা ওয়াশিংটনের আছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

এই যুদ্ধের বিষয়ে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে তা হলো, এর মধ্যে ইরান সম্ভবত গোপন পরমাণু পরীক্ষা চালিয়েছে। দেশটির সংসদে পরমাণু প্রকল্পের সম্প্রসারণ সম্পর্কে একটি বিল উত্থাপন করা হয়েছে। তেহরান টাইমসে ইরানের পরমাণু শক্তিধর হওয়ার বিষয়ে ঘোষণা দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ইরানের নেতারা পরমাণু শক্তিকে বেশ কিছু দিন ধরে তার নিরাপত্তার রক্ষাকবচ ভাবছেন বলে মনে হয়। ফলে ভেতরে ভেতরে পরমাণু শক্তি অর্জনে তেহরান অনেক দূর এগিয়েছে। কারো ধারণা, ডজনখানেক পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলেছে ইরান। আর ইসরাইল ইরানি পরমাণু কেন্দ্রে হামলা চালালে পাল্টা হিসাবে ইসরাইলি পরমাণু প্রকল্প গুঁড়িয়ে দেয়া হবে।

জো বাইডেন তার মেয়াদের শেষ দিনগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু করতে চান না বলে মনে হয়। তবে সেই যুদ্ধ অনিবার্য হলে তিনি মনে করতে পারেন যে তাকে অবশ্যই ইসরাইলের জয় নিশ্চিত করতে হবে। তার ধারণা, ইসরাইল তার পক্ষেই মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্নির্মাণ করছে। এতে করে নেতানিয়াহু হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে টেনে আনতে সফল হতে পারেন। এর আগে নেতানিয়াহু যে হামলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ইসরাইল যদি সেদিকে এগিয়ে যায়, তবে এটি শেষ পর্যন্ত ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিকে লক্ষ্যবস্তু করতে পারে। সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট টুইট করেছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার জন্য, ‘এই সন্ত্রাসী শাসনকে মারাত্মকভাবে পঙ্গু করতে’ ইসরাইলকে ‘এখন’ কাজ করতে হবে।

নেতানিয়াহু তার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় চারটি পৃথক অনুষ্ঠানে ইরানে আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন। পূর্ববর্তী আমেরিকান প্রেসিডেন্টরা তাকে থামিয়েছিলেন। এবার নেতানিয়াহু অনুভব করতে পারেন, ‘এই সুযোগটি মিস করা উচিত নয়’।

বলেছিলেন, ‘ইসরাইল একটি চৌরাস্তায় রয়েছে। আমি মনে করি এর [ইসরাইলের] পরিচয় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশের আত্মা এখন যুদ্ধক্ষেত্র এবং ফলাফল শুধু ইসরাইলের আকৃতিই নয়, আগামী বহু বছরের জন্য, ইহুদি ধর্মের আকারও নির্ধারণ করবে।’

এই অন্তর্নিহিত দ্ব›দ্বটি এক শতাব্দী আগে বিশিষ্ট ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদ ইউসুফ দিয়া আল-খালিদি অনুমান করেছিলেন। ১৮৯৯ সালে, আল-খালিদি আধুনিক রাজনৈতিক ইহুদিবাদের প্রতিষ্ঠাতা থিওডর হার্জলকে একটি পূর্বনির্ধারিত চিঠি লিখে সতর্ক করেন যে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা অনিবার্যভাবে সংঘর্ষ ও সহিংসতার দিকে নিয়ে যাবে।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিভিন্ন মার্কিন ও ব্রিটিশ কমিশনের অনুসন্ধানে তার উদ্বেগ প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। স্থানীয় জনগণের মতামত সংগ্রহের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের পাঠানো ১৯১৯ সালের কিং-ক্রেন কমিশন ফিলিস্তিনের আদিবাসী আরব জনগোষ্ঠীর মধ্যে জায়নবাদী প্রকল্পের তীব্র বিরোধিতা খুঁজে পায়। কমিশন উল্লেখ করে যে, আরবরা তাদের নিজেদের ভূমিতে সংখ্যালঘু হওয়ার ভয় পায় এবং ইহুদিবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ঔপনিবেশিকতার একটি রূপ হিসাবে দেখে যা তাদের স্থানচ্যুতি এবং প্রান্তিককরণের দিকে নিয়ে যায়।

গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের সামরিক অভিযানে ৪২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। পশ্চিমা ডাক্তার এবং স্বনামধন্য চিকিৎসা প্রকাশনা অনুমান করে যে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ১১৮,০০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা গাজার মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশেরও বেশি। যাতে আগের চেয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো ইহুদিবাদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিষেবার জন্য অবিরাম সহিংসতা এবং সংঘর্ষের প্রয়োজন। শত্রুদের একটি অন্তহীন সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা প্রকৃতপক্ষে, হার্জেল নিজেই পূর্বাভাস করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ইহুদি জাতির অস্তিত্ব একটি সাধারণ শত্রুর উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে। ইহুদি জাতিসত্তার স্থায়িত্ব প্রতিপক্ষের ক্রমাগত উপস্থিতির ওপর নির্ভরশীল, এমন একটি ধারণা যা মৌলিকভাবে ঐতিহ্যের পরিবর্তে সঙ্ঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে ইহুদি পরিচয়কে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে।

নেতানিয়াহু সেই শত্রুতার চাষ করে যাচ্ছেন এখন নির্মমতা দিয়ে। যদিও গত এক বছরে, তার অপ্রতিরোধ্য সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও, ইসরাইল বেশ কয়েকটি কৌশলগত পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে। শুরুতে, সামরিক শক্তি হিসেবে ইসরাইলি অপরাজেয়তার মিথ ভেঙে গেছে। গাজায় হামাসকে নির্মূল করতে ব্যর্থ হয়েছে ইসরাইল। এই ব্যর্থতা ইসরাইলের সামরিক শক্তির সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করেছে এবং এর দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধকে চ্যালেঞ্জ করেছে, যা দাহিয়া মতবাদ নামে পরিচিত, যা ইসরাইলের অনুভূত অজেয়তা বজায় রাখার জন্য অপ্রতিরোধ্য শক্তির হুমকির ওপর নির্ভর করে।

পরকীয়া রাষ্ট্র!
ইসরাইল বিশ্বের দৃষ্টিতে একটি পরকীয়া রাষ্ট্র হিসেবে তার মর্যাদা তৈরি করেছে। গাজায় বর্বরতা, প্রতিবেশী দেশগুলোতে সঙ্ঘাতের স¤প্রসারণের সাথে, শিকার রাষ্ট্র হওয়ার তার যে কোনো ভান ছিনিয়ে নিয়েছে। ইসরাইল আর বিশ্বাসযোগ্যভাবে দাবি করতে পারে না যে অস্তিত্বের হুমকির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষায় সে কাজ করছে। হলোকাস্টের ঐতিহাসিক ট্রমা এবং ইহুদি-বিদ্বেষের অভিজ্ঞতার মধ্যে নিহিত একটি বর্ণনা এখন বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। পরিবর্তে, ইসরাইল নিজেকে আগ্রাসী হিসাবে প্রকাশ করেছে। যে দু’টি স্তম্ভের ওপর ইসরাইল তার নীতি তৈরি করেছে সেই অপরাজেয়তা এবং অন্যায়ের শিকার মিথ ভেঙে পড়েছে। ইসরাইলের সামরিক শক্তির সীমা এবং বেসামরিক নাগরিকদের দুর্দশা চাপিয়ে দেয়ার জন্য তার ভয়ঙ্কর ইচ্ছা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে।

গত বছরের ঘটনা প্রমাণ করেছে যে ইহুদিবাদ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতার সাথে মৌলিকভাবে বেমানান। ইসরাইলের কৌশলগত পরাজয় পরিবর্তনের একটি সুযোগ উপস্থাপন করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য সঙ্ঘাতের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্মূল্যায়ন করা এবং ইসরাইলি সমাজের জন্য ইহুদিবাদী প্রকল্পের কেন্দ্রস্থলে থাকা দ্ব›দ্বগুলোর মোকাবিলা করার সময় এসেছে। শুধু এই মৌলিক বিষয়গুলো সমাধানের মাধ্যমে আমরা সহিংসতার চক্র ভেঙে এই অঞ্চলে একটি টেকসই শান্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার আশা করতে পারি।

mrkmmb@gmail.com

সূত্র: নয়া দিগন্ত

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

ইসরাইলের চূড়ান্ত যুদ্ধ ও বিলোপ শঙ্কা

আপডেট সময় ০১:২৬:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪

মাসুম খলিলী      ১৫ অক্টোবর ২০২৪

ইসরাইল কি মধ্যপ্রাচ্যে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু করেছে? দেশটির শীর্ষ নেতাদের কথায় সেটিই মনে হওয়া স্বাভাবিক। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটিচ এক্স বার্তায় লিখেছেন, ‘আমি এমন একটি ইহুদি রাষ্ট্র চাই যাতে জর্দান, লেবানন এবং মিসর, সিরিয়া, ইরাক ও সৌদি আরবের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত থাকে। আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ রাবীদের মতে, জেরুজালেম থেকে দামেস্ক পর্যন্ত সমস্ত পথ আমাদের জন্য প্রসারিত হবে।’

অন্যদিকে নেতানিয়াহুর সর্বশেষ এক্স বার্তা হলো, ‘একটি দীর্ঘ যুদ্ধের অতল গহ্বরে পতিত হওয়ার আগে লেবাননকে বাঁচানোর একটি সুযোগ রয়েছে। সেটি না নিলে যা আমরা গাজায় ঘটতে দেখছি সেই ধ্বংস ও দুর্ভোগের দিকে লেবাননকে নিয়ে যাবে।’ নেতানিয়াহু চাইছেন, লেবাননের সরকার ও সেনাবাহিনী হিজবুল্লাহর বিপক্ষে গিয়ে ইসরাইলের কাছে আত্মসমর্পণ করুক। সেটি হলে বেজালেল স্মোটিচের চাওয়া অনুসারে লেবাননকে ইসরাইলের মানচিত্রভুক্ত করা সম্ভব হবে।

অন্যরা কী ভাবছেন
ইসরাইল যে তার মানচিত্র স¤প্রসারণের যুদ্ধ শুরু করেছে সেটি এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। ইরান অক্ষ ছাড়া ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আরব নেতারা খুব একটা কথা বলেন না। এরদোগান বলছেন; কিন্তু তিনি ঠিক কতটা বা কবে কী করবেন তা অনুমান করা মুশকিল। তবে তুরস্কের সামনে ব্যাপক ঝুঁকি রয়েছে। দেশটির শাসক জোটের অন্যতম নেতা বাসেলিও বলেছেন, ‘আজ, সমস্যাটি বৈরুতের নয়, আঙ্কারার। টার্গেট ইস্তাম্বুল, দামেস্ক ও বাগদাদ নয়। ইসরাইলের গোপন এজেন্ডায় রয়েছে তুরস্ক। ক্ষেপণাস্ত্র ও হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী টার্গেট আনাতোলিয়ান ভ‚গোল। আপনি যদি পুরনো রাজনৈতিক গতিশীলতা পরিবর্তন করেন তবে আপনি এই ভ‚গোলটি হারাবেন। এটাই আজকের বিপদ।’

বাসেলির বক্তব্য, ‘ইসরাইলকে থামাতে জরুরিভাবে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে।’ খুবই সত্য এবং তা এত গুরুত্বপূর্ণ যে, কেউ ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘আত্মরক্ষামূলক’ অবস্থানে থাকলে সে হেরে যাবে।

বস্তুত ৭ অক্টোবর হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক বছর পর মধ্যপ্রাচ্য আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে চলে এসেছে যে এই অঞ্চলে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ইসরাইল যে কোনো সময় ইরানে হামলা করবে বলে ঘোষণা করেছেন নেতানিয়াহু। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োব গ্যালান্ট বলেছেন, এই হামলা হবে সুনির্দিষ্ট বিপর্যয়কর ও ধ্বংসকরী। জবাবে ইরান ইসরাইলের ডেমোনা পরমাণু প্রকল্পের একটি নকশা প্রকাশ করে দুই মিনিটের এক ভিডিও প্রকাশ করেছে। তাতে তেহরান এই বার্তা দিয়েছে যে, ইরানে হামলা হলে তার প্রতিশোধ হবে ভয়ঙ্কর। ইরানের তেলক্ষেত্রে হামলা হলে ইসরাইলের তেলক্ষেত্র অবশিষ্ট থাকবে না।

ভয়ঙ্কর যুদ্ধ?
ইরান-ইসরাইলের এই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া যে কতটা ভয়ঙ্কর হবে তা অনুমান করে যুক্তরাষ্ট্র এটি ঠেকানোর জন্য কাজ শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। যদিও ইসরাইলকে নিবৃত্ত করার ক্ষমতা কতটা ওয়াশিংটনের আছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

এই যুদ্ধের বিষয়ে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে তা হলো, এর মধ্যে ইরান সম্ভবত গোপন পরমাণু পরীক্ষা চালিয়েছে। দেশটির সংসদে পরমাণু প্রকল্পের সম্প্রসারণ সম্পর্কে একটি বিল উত্থাপন করা হয়েছে। তেহরান টাইমসে ইরানের পরমাণু শক্তিধর হওয়ার বিষয়ে ঘোষণা দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ইরানের নেতারা পরমাণু শক্তিকে বেশ কিছু দিন ধরে তার নিরাপত্তার রক্ষাকবচ ভাবছেন বলে মনে হয়। ফলে ভেতরে ভেতরে পরমাণু শক্তি অর্জনে তেহরান অনেক দূর এগিয়েছে। কারো ধারণা, ডজনখানেক পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলেছে ইরান। আর ইসরাইল ইরানি পরমাণু কেন্দ্রে হামলা চালালে পাল্টা হিসাবে ইসরাইলি পরমাণু প্রকল্প গুঁড়িয়ে দেয়া হবে।

জো বাইডেন তার মেয়াদের শেষ দিনগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু করতে চান না বলে মনে হয়। তবে সেই যুদ্ধ অনিবার্য হলে তিনি মনে করতে পারেন যে তাকে অবশ্যই ইসরাইলের জয় নিশ্চিত করতে হবে। তার ধারণা, ইসরাইল তার পক্ষেই মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্নির্মাণ করছে। এতে করে নেতানিয়াহু হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে টেনে আনতে সফল হতে পারেন। এর আগে নেতানিয়াহু যে হামলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ইসরাইল যদি সেদিকে এগিয়ে যায়, তবে এটি শেষ পর্যন্ত ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিকে লক্ষ্যবস্তু করতে পারে। সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট টুইট করেছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার জন্য, ‘এই সন্ত্রাসী শাসনকে মারাত্মকভাবে পঙ্গু করতে’ ইসরাইলকে ‘এখন’ কাজ করতে হবে।

নেতানিয়াহু তার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় চারটি পৃথক অনুষ্ঠানে ইরানে আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন। পূর্ববর্তী আমেরিকান প্রেসিডেন্টরা তাকে থামিয়েছিলেন। এবার নেতানিয়াহু অনুভব করতে পারেন, ‘এই সুযোগটি মিস করা উচিত নয়’।

বলেছিলেন, ‘ইসরাইল একটি চৌরাস্তায় রয়েছে। আমি মনে করি এর [ইসরাইলের] পরিচয় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশের আত্মা এখন যুদ্ধক্ষেত্র এবং ফলাফল শুধু ইসরাইলের আকৃতিই নয়, আগামী বহু বছরের জন্য, ইহুদি ধর্মের আকারও নির্ধারণ করবে।’

এই অন্তর্নিহিত দ্ব›দ্বটি এক শতাব্দী আগে বিশিষ্ট ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদ ইউসুফ দিয়া আল-খালিদি অনুমান করেছিলেন। ১৮৯৯ সালে, আল-খালিদি আধুনিক রাজনৈতিক ইহুদিবাদের প্রতিষ্ঠাতা থিওডর হার্জলকে একটি পূর্বনির্ধারিত চিঠি লিখে সতর্ক করেন যে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা অনিবার্যভাবে সংঘর্ষ ও সহিংসতার দিকে নিয়ে যাবে।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিভিন্ন মার্কিন ও ব্রিটিশ কমিশনের অনুসন্ধানে তার উদ্বেগ প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। স্থানীয় জনগণের মতামত সংগ্রহের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের পাঠানো ১৯১৯ সালের কিং-ক্রেন কমিশন ফিলিস্তিনের আদিবাসী আরব জনগোষ্ঠীর মধ্যে জায়নবাদী প্রকল্পের তীব্র বিরোধিতা খুঁজে পায়। কমিশন উল্লেখ করে যে, আরবরা তাদের নিজেদের ভূমিতে সংখ্যালঘু হওয়ার ভয় পায় এবং ইহুদিবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ঔপনিবেশিকতার একটি রূপ হিসাবে দেখে যা তাদের স্থানচ্যুতি এবং প্রান্তিককরণের দিকে নিয়ে যায়।

গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের সামরিক অভিযানে ৪২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। পশ্চিমা ডাক্তার এবং স্বনামধন্য চিকিৎসা প্রকাশনা অনুমান করে যে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ১১৮,০০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা গাজার মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশেরও বেশি। যাতে আগের চেয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো ইহুদিবাদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিষেবার জন্য অবিরাম সহিংসতা এবং সংঘর্ষের প্রয়োজন। শত্রুদের একটি অন্তহীন সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা প্রকৃতপক্ষে, হার্জেল নিজেই পূর্বাভাস করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ইহুদি জাতির অস্তিত্ব একটি সাধারণ শত্রুর উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে। ইহুদি জাতিসত্তার স্থায়িত্ব প্রতিপক্ষের ক্রমাগত উপস্থিতির ওপর নির্ভরশীল, এমন একটি ধারণা যা মৌলিকভাবে ঐতিহ্যের পরিবর্তে সঙ্ঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে ইহুদি পরিচয়কে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে।

নেতানিয়াহু সেই শত্রুতার চাষ করে যাচ্ছেন এখন নির্মমতা দিয়ে। যদিও গত এক বছরে, তার অপ্রতিরোধ্য সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও, ইসরাইল বেশ কয়েকটি কৌশলগত পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে। শুরুতে, সামরিক শক্তি হিসেবে ইসরাইলি অপরাজেয়তার মিথ ভেঙে গেছে। গাজায় হামাসকে নির্মূল করতে ব্যর্থ হয়েছে ইসরাইল। এই ব্যর্থতা ইসরাইলের সামরিক শক্তির সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করেছে এবং এর দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধকে চ্যালেঞ্জ করেছে, যা দাহিয়া মতবাদ নামে পরিচিত, যা ইসরাইলের অনুভূত অজেয়তা বজায় রাখার জন্য অপ্রতিরোধ্য শক্তির হুমকির ওপর নির্ভর করে।

পরকীয়া রাষ্ট্র!
ইসরাইল বিশ্বের দৃষ্টিতে একটি পরকীয়া রাষ্ট্র হিসেবে তার মর্যাদা তৈরি করেছে। গাজায় বর্বরতা, প্রতিবেশী দেশগুলোতে সঙ্ঘাতের স¤প্রসারণের সাথে, শিকার রাষ্ট্র হওয়ার তার যে কোনো ভান ছিনিয়ে নিয়েছে। ইসরাইল আর বিশ্বাসযোগ্যভাবে দাবি করতে পারে না যে অস্তিত্বের হুমকির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষায় সে কাজ করছে। হলোকাস্টের ঐতিহাসিক ট্রমা এবং ইহুদি-বিদ্বেষের অভিজ্ঞতার মধ্যে নিহিত একটি বর্ণনা এখন বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। পরিবর্তে, ইসরাইল নিজেকে আগ্রাসী হিসাবে প্রকাশ করেছে। যে দু’টি স্তম্ভের ওপর ইসরাইল তার নীতি তৈরি করেছে সেই অপরাজেয়তা এবং অন্যায়ের শিকার মিথ ভেঙে পড়েছে। ইসরাইলের সামরিক শক্তির সীমা এবং বেসামরিক নাগরিকদের দুর্দশা চাপিয়ে দেয়ার জন্য তার ভয়ঙ্কর ইচ্ছা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে।

গত বছরের ঘটনা প্রমাণ করেছে যে ইহুদিবাদ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতার সাথে মৌলিকভাবে বেমানান। ইসরাইলের কৌশলগত পরাজয় পরিবর্তনের একটি সুযোগ উপস্থাপন করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য সঙ্ঘাতের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্মূল্যায়ন করা এবং ইসরাইলি সমাজের জন্য ইহুদিবাদী প্রকল্পের কেন্দ্রস্থলে থাকা দ্ব›দ্বগুলোর মোকাবিলা করার সময় এসেছে। শুধু এই মৌলিক বিষয়গুলো সমাধানের মাধ্যমে আমরা সহিংসতার চক্র ভেঙে এই অঞ্চলে একটি টেকসই শান্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার আশা করতে পারি।

mrkmmb@gmail.com

সূত্র: নয়া দিগন্ত