নিরাপদ অঞ্চলই রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান
- আপডেট সময় ০১:১৯:৫৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪
- / ১৩ বার পড়া হয়েছে
- মাসুম খলিল
2০১৭ সালে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আসার পর সাত বছরের বেশি সময় পার হলেও সঙ্কটের বাস্তবমুখী সমাধানের কোনো লক্ষণ নেই। অধিকন্তু রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে নতুন করে শরণার্থীর ঢেউ শুরু হয়েছে। এ প্রবণতা চললে রাখাইনে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশে চলে আসতে পারেন।
এ অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস রোহিঙ্গাদের জন্য তাদের মাতৃভূমির আবাসস্থলে অধিকারসহ পুনর্বাসনে একটি নিরাপদ জোন গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার টমাস অ্যান্ড্রুজের সাথে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা তার ধারণা তুলে ধরেন। এ ধারণা অনুসারে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারের রাখাইনে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর জন্য একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ তৈরি হবে। আর এই উদ্যোগই সঙ্কট সমাধানের প্রধান উপায় হতে পারে।
রাখাইনের সহিংসতা এর মধ্যে একটি ‘গভীর সঙ্কট’ তৈরি করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে কক্সবাজারে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান চালায় দেশটির সেনাবাহিনী ও স্থানীয় উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা। গ্রাম ও ক্ষেতখামার পুড়িয়ে দেয়া হয়। হামলা, লুটপাট ও ধর্ষণের মতো জঘন্য ও বর্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জীবন বাঁচাতে দলে দলে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে, যার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১১ লাখ। বিপুল এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আশ্রয় মেলে কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায়। তাদের আবাসনে হুমকিতে পড়েছে ওই জেলার প্রাণ-প্রকৃতি।
আগের সরকারের আমলে কয়েক দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নথিপত্র চালাচালি হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। উপরন্তু মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ সব ভণ্ডুল করে দিয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতিসঙ্ঘের সাথে কাজ শুরু করেছে। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের তিন দফা প্রস্তাব তার অংশ।
রোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিস্থিতি : ২০১৭ সালের আগে আরাকানে ২৬-২৮ লাখ রোহিঙ্গা ছিলেন। ২০১৭ সালের গণহত্যার পরে প্রায় ১৪-১৫ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে যান। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তখন থেকে সহিংসতার মাত্রা অসহনীয়। রোহিঙ্গারা এখন বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অরক্ষিত জনসংখ্যা। আরাকান আর্মির (আআ) সহিংসতা, হুমকি, মানবপাচার এবং নানা ধরনের শোষণ রোহিঙ্গাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। ২০২৩ সালের প্রথম দিক থেকে রোহিঙ্গাদের টার্গেট করা বাড়িয়ে দেয় আরাকান আর্মি। অক্টোবর ২০২৩ নাগাদ, এসব আক্রমণ সরাসরি এবং তীব্র হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালে দুই লাখ ৪০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। ৬০ হাজারের বেশি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এ সময় অগণিত রোহিঙ্গা নিহত হন। এখন ছয় লাখের কম রোহিঙ্গা আরাকানে রয়েছেন, যাদের ৭০ শতাংশই অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত।
নিরাপদ অঞ্চলের ধারণা : ‘নিরাপদ অঞ্চল’ দ্বারা আরাকানের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা, মংডু থেকে শুরু করে বুথিডাং, রাথেডাংসহ সিত্তওয়ের কিছু অংশ নিয়ে একটি সুরক্ষিত বাফার জোন প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। ওই অঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে ৯৫ শতাংশের বেশি জনসংখ্যা রোহিঙ্গা ছিলেন। অঞ্চলটি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয় বহন করে। এলাকাটির সবকিছু রোহিঙ্গা ঐতিহ্যের ছাপ বহন করে।
প্রাথমিকভাবে, মংডুর সম্পূর্ণ এবং বুথিডাংয়ের একটি অংশকে নির্দিষ্ট করা হবে। এর লক্ষ্য হবে এসব অঞ্চলকে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা লাইনের আওতায় সুরক্ষিত করা, যার অধীনে একটি বাফার জোন তৈরি করা হবে; যেখানে থাকবে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সামরিক নিয়ন্ত্রণ। এতে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নিজেদের ঘরে ফিরতে পারেন। যেখানে থাকবে একটি কাঠামোগত ও নিরাপদ পদ্ধতি। নিরাপদ অঞ্চলটি একটি ভৌগোলিক স্থানের চেয়ে বেশি কিছু নিশ্চিত করবে। এটি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যে কাজ করে-
১. শারীরিক সুরক্ষা : নিরাপদ অঞ্চল একটি ঢাল হিসেবে কাজ করবে দুর্বলদের সুরক্ষায়। এটি সহিংসতা, শোষণ এবং বাস্তুচ্যুতি থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেবে। নিরাপদ অঞ্চলের সীমানার মধ্যে আন্তর্জাতিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যেকোনো শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ড থেকে ভেতর-বাইরের পক্ষগুলোকে বিরত রাখা যাবে।
২. পরিচয় পুনরুদ্ধার : পৈতৃক জমি পুনরুদ্ধার এবং বসবাসের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা তাদের স্বত্ব ও পরিচয়ের বোধ ফিরে পাবেন, যা নিয়মতান্ত্রিকভাবে কয়েক দশকের নিপীড়নের মাধ্যমে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
৩. মানবিক সহায়তা : খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ নিশ্চিত করে নিরাপদ অঞ্চল মানবিক সহায়তার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। হস্তক্ষেপ ছাড়া আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওগুলো সেখানে কাজ করতে পারবে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো জীবন পুনর্গঠনে প্রয়োজনীয় সম্পদ সহায়তা দেবে।
৪. আইনি এবং সামাজিক সুরক্ষা : নিরাপদ অঞ্চলে আন্তর্জাতিক মনিটররা নিশ্চিত করবে যাতে রোহিঙ্গাদের অধিকার সংরক্ষিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে জোরপূর্বক শ্রম, পাচার ও বৈষম্য প্রতিরোধ।
৫. প্রত্যাবাসনে ভিত্তি : নিরাপদ অঞ্চল একটি নিরাপদ এবং কাঠামোগত পথ তৈরি করবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে। এটি ইন্টিগ্রেশন, বিশ্বাস পুনর্গঠন এবং নাগরিকত্ব ও সমান অধিকার সম্পর্কিত সমস্যার মূল কারণগুলো সমাধান করবে।
মোট কথা, একটি নিরাপদ অঞ্চল শুধু নিরাপত্তার বিষয় নয়; এটি আশা ও স্থিতিস্থাপকতা আনবে। রোহিঙ্গাদের মর্যাদা ও মানবতা পুনরুদ্ধারের পদক্ষেপ নেবে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিজেরা নিজেদের ভূমিতে শান্তিতে জীবন পুনর্নির্মাণ নিশ্চিত করতে পারবেন।
প্রধান অংশীজনদের সম্পৃক্ত করা : রোহিঙ্গাসঙ্কট কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে এর জটিল দিক ভালোভাবে চিহ্ন্তি করতে হবে। আরাকানের (রাখাইন) বাস্তবতা এবং বাস্তবসম্মতভাবে বর্তমান সব অংশীজনকে এর সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।
মিয়ানমার মিলিটারি : ঐতিহাসিকভাবে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী (তাতমাদাও) রোহিঙ্গাদের প্রতি সবচেয়ে বেশি শত্রুতা করেছে। ২০১৭ সালের গণহত্যা পর্যন্ত কয়েক দশকের নিপীড়নে এরা নেতৃত্ব দিয়েছে। তবে, ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে গতিশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন হয়েছে। জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি), পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং আরাকান আর্মিসহ জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী এখন ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। আরাকানে, তাতমাদাওয়ের অবস্থান ক্রমে অস্থিতিশীল। সামরিক বাহিনীর দেশব্যাপী বৃহত্তর ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বহুমুখী যুদ্ধ বজায় রাখতে সম্পদের অভাব রয়েছে। এ দুর্বলতা নিরাপদ জোন গঠনে সম্পৃক্ততায় একটি সুযোগ তৈরি করেছে।
সহযোগিতা উৎসাহিত করা : নিরাপদ অঞ্চল গড়তে সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক সুবিধার ওপর জোর দিতে হবে, যেমন- নিষেধাজ্ঞা সহজ করা ও অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্রদান এবং সহিংসতা কমিয়ে এনে রোহিঙ্গাসঙ্কট সমাধান করা।
জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) : নির্বাসিত সরকার হিসেবে গঠিত এনইউজি রোহিঙ্গাদের পরিচয় ও অধিকার সম্পর্কে অভ‚তপূর্ব স্বীকৃতি দিয়েছে। এ অবস্থান রোহিঙ্গাসঙ্কটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান এবং মিয়ানমারের ভবিষ্যতের জন্য তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন করে তুলেছে। তবে বর্তমানে এনইউজির আরাকানে সীমিত প্রভাব রয়েছে, অঞ্চলটি মূলত আরাকান আর্মি বা তাতমাদাওয়ের নিয়ন্ত্রণে।
কৌশলগত পদ্ধতি : ভবিষ্যতের যেকোনো জাতীয় কাঠামোতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার শর্তে রাজনৈতিক জোটের সমর্থন দৃঢ় করতে সহযোগিতা করতে হবে।
আন্তর্জাতিক অ্যাডভোকেসি : মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য পক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগ করে নিরাপদ আশ্রয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি ব্যস্ততা : আরাকানে বর্তমান প্রভাব ন্যূনতম হলেও এনইউজির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা নিরাপদ অঞ্চলকে একীভূত করার পথ তৈরি করে ভবিষ্যতে একটি ঐক্যবদ্ধ মিয়ানমার নিশ্চিত করা যাবে।
আরাকান আর্মি : আরাকান আর্মি আরাকানে ধ্বংসাত্মক শক্তি হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে এবং ধারাবাহিকভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈরিতা বজায় রেখেছে। ক‚টনৈতিকভাবে রোহিঙ্গারা আআ’র সাথে জড়িত থাকার চেষ্টা করা সত্ত্বেও তাদের লক্ষ্য যে একটি রোহিঙ্গামুক্ত আরাকান প্রতিষ্ঠা সেটি গণহত্যাসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট হয়েছে। রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, বাস্তুচ্যুতি ও নাগরিক অধিকার দানে তাদের অস্বীকৃতির কট্টরপন্থী অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সাথে একক আলোচনায় অনুকূল ফল আসার সম্ভাবনা কম বলে মনে হচ্ছে।
কৌশলগত পদ্ধতি : সামরিক ব্যবস্থা- নিরাপদ অঞ্চলের মধ্যে রোহিঙ্গাবাহিনীকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে, যা আরাকান আর্মির প্রভাবকে ভারসাম্যপূর্ণ করবে। তাদের সাথে আলোচনা হবে রোহিঙ্গাদের অধিকারের গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতির শর্তে। এতে রাজি না হলে তাদের বৈশ্বিক বিচ্ছিন্নতা ঝুঁকি প্রদর্শন করতে হবে, প্রয়োজনে সামরিক চাপ তৈরি করতে হবে।
প্রত্যেক অংশীজনের রোহিঙ্গাসঙ্কট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ততা হতে পারে বাস্তববাদী কূটনীতির মাধ্যমে। এনইউজির সম্পর্কের ভিত্তি হবে দীর্ঘমেয়াদে রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষা ও স্বীকৃতির বিনিময়ে মিয়ানমারের অখণ্ডতা রক্ষা করা। আরাকান আর্মির অবশ্য দৃঢ় ও সিদ্ধান্তমূলক অবস্থান প্রয়োজন, যাতে তাদের শত্রুতা বন্ধ করতে এবং নিরাপদ অঞ্চল সুরক্ষিত করার পদক্ষেপ নিতে রাজি হতে হবে। একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতির জন্য যে সমঝোতা, চাপ এবং কৌশলগত সামরিক ব্যবস্থা নিতে হয় সেটি গ্রহণ করা হবে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে আরাকান আর্মির প্রভাব : আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় একটি উল্লেখযোগ্য ও ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে, আরাকান আর্মির সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছে জেএসএস (পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি) কেএনএফ ও ইউপিডিএফের (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট) মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলো। এই দলগুলো আরাকান আর্মিকে এই অঞ্চলের দুর্বলতাগুলো কাজে লাগানোর সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন করছে।
২০২৩ সাল থেকে, আরাকান আর্মি নিয়োগসহ বাংলাদেশের মধ্যে তার কার্যক্রম বাড়িয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সম্প্রদায় তাদের বাহিনীর জন্য লড়াই করতে মারমা, চাকমাদের আট থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক পেমেন্ট অফার করে এবং আরাকানের প্রতিশ্রুতিপূর্ণ ভূমি দেয়ার কথা বলে উপজাতি যুবকদের তাদের দলে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করে। এ নিয়োগ অভিযান শুধু আরাকান আর্মিকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করে না; বরং এর মধ্যে অসন্তোষ ও বিভাজনও বাড়ে বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে।
অধিকন্তু আরাকান আর্মি এ অঞ্চলে অস্ত্রের বিস্তার সহজতর করেছে, জেএসএস ও ইউপিডিএফের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোর কাছে দিচ্ছে অ্যাসল্ট রাইফেল, রকেট চালিত গ্রেনেড (আরপিজি) এবং মর্টার থেকে শুরু করে অনেক বিধ্বংসী অস্ত্র। এ অস্ত্র হস্তান্তর এগুলোকে সীমান্ত এলাকায় ক্ষমতা একত্রিত করতে এবং বাংলাদেশী রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য সাহসী করছে।
আরাকান আর্মির অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার নানা উপায়ে বাংলাদেশকে হুমকির মুখে ফেলছে-
১. বর্ডার সিকিউরিটি : সীমান্তে আআ’র কার্যক্রম নিরাপত্তাকে দুর্বল করছে এবং বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করছে। এতে এসব এলাকায় সামরিকীকরণ বাড়তে পারে, সংঘর্ষের সৃষ্টি করে একটি অস্থির পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
২. পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীলতা : বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে আআ সক্রিয়ভাবে পার্বত্য অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলায় বাংলাদেশের পক্ষে নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে, যা ইতোমধ্যে ঐতিহাসিক উত্তেজনাকর অঞ্চলে পরিণত হতে শুরু করেছে।
৩. মাদক ও মানবপাচার : মাদকপাচার নেটওয়ার্কে আআ’র সম্পৃক্ততা বাংলাদেশে মাদকের প্রবাহকে বাড়িয়ে তোলে এবং মানবপাচারের নেটওয়ার্ককে ইন্ধন জোগায়। এটি সংগঠিত অপরাধ দমনে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে বাধার মুখে ফেলে।
৪. রোহিঙ্গাসঙ্কট দীর্ঘায়িত করা : রোহিঙ্গাদের প্রতি আআ’র শত্রুতা এবং তাদের অধিকারের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান সঙ্কটকে দীর্ঘস্থায়ী করে প্রত্যাবাসন অসম্ভব করে তুলছে। এ হিসেবে আআ শক্তিশালী হলে তারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান দৃঢ় করে তাদের স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রহীন করবে এবং বাংলাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য রোহিঙ্গারা আটকে যাবে।
আআ’র সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরা না হলে তা রোহিঙ্গাসঙ্কট কেবল আরো গভীর করবে না; একই সাথে বাংলাদেশের জন্য এটি স্থায়ী জাতীয় নিরাপত্তা সঙ্কট তৈরি করবে।
বাংলাদেশের জন্য সুবিধা-
রোহিঙ্গাসঙ্কটের সমাধান বাংলাদেশের জন্য উল্লেখযোগ্য সুবিধা বয়ে আনবে, যার রয়েছে একাধিক মাত্রা-
১. শক্তিশালী সীমান্ত নিরাপত্তা : প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গা জনসংখ্যার সাথে একটি স্থিতিশীল ও নিরাপদ আরাকান রাজ্য আরাকান আর্মির মতো বৈরী শক্তির বিরুদ্ধে বাফার অঞ্চল হিসেবে কাজ করতে পারে এবং আন্তঃসীমান্ত হুমকি কমাতে এটি সাহায্য করবে।
২. নিরাপত্তাঝুঁকি হ্রাস : র্যাডিক্যালাইজেশন, সংগঠিত অপরাধ এবং পাচারের নেটওয়ার্ক ইত্যাদির কারণে বর্তমান অস্থিতিশীল পরিবেশ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি বাড়াচ্ছে, এ ধরনের ঝুঁকি কমাবে।
৩. উন্নত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা : সঙ্কটের একটি স্থায়ী সমাধানে উন্নত হবে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা, প্রতিবেশীর সাথে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা সম্ভব হবে। একই সাথে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কটের চাপ কমবে।
৪. বৈশ্বিক প্রভাব বাড়বে : সফলভাবে সঙ্কটের মোকাবেলা করতে পারলে বাংলাদেশকে একটি সক্রিয় এবং মানবিক বৈশ্বিক পক্ষ হিসেবে তার কূটনীতিকে শক্তিশালী করবে। একই সাথে আন্তর্জাতিক শক্তি ও সংস্থাগুলোতে বাড়বে প্রভাব ও অংশীদারিত্ব। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের নিজস্ব স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি, এর সীমানা শক্তিশালী করা এবং বিশ্বমঞ্চে মর্যাদা উন্নত করতে পারবে ঢাকা।
রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল তৈরির বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা দরকার। এর লক্ষ্য হবে কোনো পক্ষের সাথে সঙ্ঘাতে না গিয়ে একটি মধ্যবর্তী সমাধানের পথ অন্বেষণ। এর জন্য প্রয়োজন নিষ্পত্তিমূলক পদক্ষেপ- রাজনৈতিক, ক‚টনৈতিক এবং দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে প্রয়োজনবোধে সামরিক চাপ।
mrkmmb@gmail.com
সূত্র : নয়াদিগন্ত