সাজেদুল হক-এর কলাম
সামনের দৃশ্যপট কেমন হবে?
- আপডেট সময় ০১:৪৬:৫৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ১৪ বার পড়া হয়েছে
ডেস্ক কলাম :
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সবে দায়িত্ব নিয়েছে। চারদিকে তখনও বিশৃঙ্খলা। দাবির খাতা খোলা শুরু হয়েছে। এরইমধ্যে একজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা সরকারকে পরামর্শ দিলেন, একটি দাবিও যেন মানা না হয়। যুক্তি ছিল, কারও দাবি মানলে গেট খুলে দেয়া হবে। তখন অন্যরাও ফর্দ নিয়ে হাজির হবেন। আদতে হয়েছেও তাই। সরকারের বয়স আজ ১১৫ দিন। এরমধ্যে সুস্থির দিন কমই কেটেছে। একের পর এক আন্দোলন, বিক্ষোভ। এক হিসাবে এ সময়ে শ’ খানেক আন্দোলন হয়েছে। সরকার অবশ্য হার্ডলাইনে যায়নি। শুরু থেকেই চেষ্টা করেছে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের। প্রশ্ন উঠেছে এর শেষ কোথায়?
কেন এই অস্থিরতা?
সরকার তখনও দায়িত্ব নেয়নি। এরইমধ্যে শাহবাগে একটি জনগোষ্ঠীর বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। আন্দোলনের ট্রেন এখনো চলছে। এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের সচিবালয়ে ঢুকে পড়া ছিল ব্যাপক আলোচিত। তারা অবশ্য দাবি আদায়ে সক্ষম হয়। অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, এটি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। পরে আনসার সদস্যদের একটি গ্রুপ বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করে। সেটা অবশ্য শক্ত হাতে মোকাবিলা করা হয়। পোশাক খাতে শুরু হওয়া আন্দোলন এখনো থামেনি। কিছু কারখানায় বেতন বকেয়া থাকাই এ খাতে অস্থিরতা প্রধান কারণ। জুট ব্যবসার হাত বদল নিয়েও শুরুতে কিছু সংঘাত হয়েছে। ভিনদেশি উস্কানির অভিযোগও করে থাকেন কেউ কেউ। শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা অবশ্য অনেককেই হতবাক করেছে। সর্বশেষ সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের গ্রেপ্তার এবং আদালত এলাকায় আইনজীবীকে হত্যার ঘটনায় বড় ধরনের সংকট তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তবে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত সতর্কতায় আপাত তা এড়ানো গেছে। এই অস্থিরতা কেন- বিশ্লেষকরা শুরু থেকেই সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। এমনিতে দুনিয়ার যে কোনো দেশেই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে অস্থির পরিস্থিতির তৈরি হয়। বাংলাদেশে ১৫ বছরের প্রবল পরাক্রমশালী শাসকের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তিনদিন দেশ সরকারবিহীন অবস্থায় ছিল। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির এটিও একটি কারণ। ৫ই আগস্ট সম্ভবত আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পুলিশের সব সদস্য থানা ছেড়ে চলে যান। তাদের কর্মক্ষেত্রে ফেরাতেও সময় লাগে। তবে পুলিশকে এখনো শতভাগ সক্রিয় করা সম্ভব হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ বাড়ার এটি প্রধান কারণ। প্রশাসনও পুরোমাত্রায় সরকারকে সহযোগিতা করছে না। পনেরো বছর এতো ধাপে দলীয়করণ করা হয়েছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলেও তা থেকে বের হতে পারেনি। কিছু ক্ষেত্রে কয়েকজন উপদেষ্টার দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে দেশি-বিদেশি নানা পক্ষের ইন্ধনের অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। পলাতক স্বৈরাচারের অর্থও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
বড় প্রশ্ন
সরকার এরইমধ্যে বিভিন্নখাতে সংস্কারের জন্য কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। বেশির ভাগ কমিশনের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ রিপোর্ট দেয়ার কথা। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে সেটি বিলম্বিত হতে পারে এমন ইঙ্গিত মিলছে। আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে যেটা বলা হয়েছে, কমিশনের রিপোর্ট পাওয়ার পর সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসবে। সেখানেই সংস্কারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কী কী সংস্কার হবে তার ওপরই নির্ভর করবে নির্বাচন কবে হবে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যত কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে এটাও বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি বলে সংস্কার লাগবে না, এখনই নির্বাচন দিয়ে দিন। তাহলে আমরা নির্বাচন দিয়ে দেবো। সংবিধান সংস্কারও একটি প্রধান প্রশ্ন। যদিও বিএনপি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটি নির্বাচিত সরকারের কাজ। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কত দিন? নির্বাচনই বা কবে হবে। বিএনপি’র পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হচ্ছে, নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করার। সরকারের পক্ষ থেকে এখনো স্পষ্ট করে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। একজন উপদেষ্টা একবার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। পরে অবশ্য এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। তিনি একটি ব্যাখ্যা দেন। আরেকটি প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পাবে? ছাত্র নেতৃত্বের একাংশ এবং কোনো কোনো মহল থেকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। তবে বিএনপি বা জামায়াতের মতো প্রধান দলগুলো এ ব্যাপারে সায় দেয়নি। সরকারও রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।
সামনের দৃশ্যপট কেমন হবে?
নানা গুজবে ভাসছে দেশ। ভারত থেকে চলছে বিরামহীন অপপ্রচার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এসব প্রচারণার কিছু প্রভাব এরইমধ্যে দেখা যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য এখনও নিয়ন্ত্রণহীন। সাধারণ মানুষের কাছে এটিই প্রধান ইস্যু। সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও বাজারে তার তেমন কোনো প্রভাব নেই। সাম্প্রতিক ইস্যুগুলো নিয়ে সরকার এরইমধ্যে বিএনপি এবং জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা করেছে। এসব আলোচনায় জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলা হয়েছে। যদিও সে ঐকমত্য কেমন হবে তা স্পষ্ট নয়। বিএনপি যতো সম্ভব দ্রুত একটি নির্বাচন চায়। বর্তমানে নির্বাচন হলে দলটির বড় জয়ের সম্ভাবনাই বেশি। নির্বাচনে বিলম্ব হলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় এ নিয়ে বিএনপি’র মধ্যে একধরনের শঙ্কা রয়েছে। দলটির বিবেচনায় ওয়ান-ইলেভেনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। বিএনপি’র পক্ষ থেকে দ্রুত নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করা হচ্ছে। জামায়াত অবশ্য নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়া করছে না। অন্যদিকে, ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া নেতারা সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছেন। তারা নতুন কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করেন কি-না সে আলোচনাও রয়েছে। এরমধ্যে ছাত্রদের সমর্থিত নাগরিক কমিটি বিভিন্ন অঞ্চলে কমিটি দিচ্ছে। সমন্বয়ক কমিটিও পুনর্গঠন হচ্ছে জেলায় জেলায়। তবে বাংলাদেশে এ ধরনের দল হলেও তা বড় কোনো প্রভাব রাখতে পারবে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার শুরু হলে দৃশ্যপটে বড় পরিবর্তন আসতে পারে কেউ কেউ এমনটা ইঙ্গিত দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে আগামীদিনে আওয়ামী লীগের ভূমিকা কী হবে তাও হবে দেখার বিষয়। ভয়েস অব আমেরিকার একটি জরিপে ৫৭ ভাগ লোক আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খান মনে করেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরার সম্ভাবনা নেই। এক আলোচনায় তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ তার নৈতিক বৈধতা হারিয়েছে। মুসলিম লীগ যেমন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তেমনি আওয়ামী লীগও বিলুপ্তির পথে রয়েছে। এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’
শেষ কথা বলে কিছু নেই
এটা প্রায়ই বলা হয়, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ৫ই আগস্টের অভাবনীয় অভ্যুত্থানের পরও বাংলাদেশ এক অস্থির সময় পার করছে। এটি কবে স্থির হবে সেটি বলা মুশকিল। সংশ্লিষ্ট কিছু সূত্র আভাস দিয়েছে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই বাংলাদেশে একটি নির্বাচন হতে পারে। যদিও এটি নানা যদি, কিন্তুর ওপর নির্ভর করে। এটা ঠিক, সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো কখনও কখনও সরকারকে চাপে রাখলেও নিজ নিজ স্বার্থেই আবার তারা সরকারকে সমর্থন দেয়। তবে ছাত্র নেতৃত্ব যদি প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন কোনো দল গঠন করে তাহলে অঙ্ক জটিল হতে পারে। সীমান্ত পরিস্থিতির দিকেও নজর রাখছেন সবাই।
সূত্র : মানবজমিন